ওয়েব (WWW) নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এর উদ্ভাবক টিম বার্নার্স-লি’র সাক্ষাৎকার
কম্পিউটার বিজ্ঞানী স্যার টিম বার্নার্স-লি সর্বাধিক পরিচিত ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (WWW) এর আবিষ্কারক হিসাবে। সিলিকন ভ্যালি থেকে ইউজারদের ব্যক্তিগত তথ্য পুনরুদ্ধার করার পরিকল্পনা নিয়ে তার সাথে আলাপ করেছেন থমাস লিং।
১৯৮৯ সালে বিখ্যাত ইউরোপীয় গবেষণা সংস্থা ‘সার্ন’-এ বৈজ্ঞানিক তথ্য আদানপ্রদান করার একটা পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছিলেন ৩৪ বছর বয়সী বিজ্ঞানী টিম বার্নার্স-লি। এক সময় এমন একটা জিনিস তিনি আবিষ্কার করেন, যা ভবিষ্যতের সবকিছুকে বদলে দিয়েছিল। তিনি 'ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব' আবিষ্কার করেন।
আবিষ্কারের ৩ দশক পরে বিশ্বজুড়ে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন প্রায় ৪.৫৭ বিলিয়ন বা সাড়ে চারশো কোটির ওপর। আর টিম বার্নাস-লি এখন ব্যস্ত নিজের সৃষ্টিকে রক্ষা করার প্রকল্প নিয়ে। বিশেষ করে, ক্রমশ বেড়ে ওঠা প্রাইভেসি বা গোপনীয়তা সংক্রান্ত জটিলতার সমাধানে তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁস হওয়ার পর অধ্যাপক স্যার টিম বার্নার্স-লি বিভিন্ন দেশের সরকারকে এই বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে অসংখ্য প্রচারণা চালিয়েছেন। এই কেলেঙ্কারিতে প্রায় ৮.৩ মিলিয়ন বা ৮৩ লক্ষ ফেসবুক ব্যবহারকারীর ডেটা বিনা সম্মতিতে সংগ্রহ করা হয়েছিল। বার্নার্স-লি’র প্রচারণার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হল ২০১৯ সালের 'কনট্রাক্ট ফর দ্য ওয়েব', যার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে ওয়েব-কে নতুনভাবে নিয়ন্ত্রণের আহ্বান জানানো হয়েছে।
তবে এই উদ্যোগের সার্বিক প্রভাব খুবই সীমিত।
যাই হোক, বার্নার্স-লি বছরের পর বছর ধরে অন্যদেরকে এই বিষয়ে দায়িত্ব গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু এখন তিনি নিজেই অনলাইন জগৎকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়ার চেষ্টা করছেন। অবশ্য তার ভাষ্যমতে, তিনি এটিকে সঠিক পথে আনতে চাচ্ছেন।
এ বিষয়ে তার প্রস্তাবনার নামকরণ হয়েছে ‘সলিড’। এটি হবে নতুন এক পদ্ধতি, যা ওয়েবকে ব্যাপক ভাবে বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে কাজ করবে। মূলত এটি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যা আপনাকে প্রাইভেট অনলাইন ডেটা স্টোর-এ (পিওডিএস) আপনার ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ করার সুযোগ করে দিবে। আর এর ওপর আপনার থাকবে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ।
বর্তমানে বেশিরভাগ ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ্লিকেশন আপনার ডেটা সংগ্রহ করে তা ‘ইনফরমেশন সাইলো’ নামের একটি পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে। এর ওপর আপনার কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এই ধরনের সার্ভিস নিয়ে সলিড-এর কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে। যেমন, আপনার পিওডিএস থেকে নির্দিষ্ট তথ্য ব্যবহারের জন্য সার্ভিসগুলিকে আপনার কাছে অনুমতি চাইতে হবে। আর আপনি চাইলে যেকোনো সময় এই অনুমতি বাতিলও করতে পারবেন।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, আপনার তথ্য উপাত্তের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ থাকবে আপনার নিজের হাতে, কোন 'বিগ টেক' কোম্পানির হাতে নয়। বর্তমানে এটি পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। তবে এই পর্যায়ে থাকা অবস্থাতেই প্ল্যাটফর্মটি ইতিমধ্যে এনএইচএস, বিবিসি, ন্যাটওয়েস্ট এবং এমনকি বেলজিয়াম সরকারের সাথেও যৌথভাবে পদ্ধতিটি পরীক্ষা করে যাচ্ছে।
তবে সলিড-এর বিস্তৃতি কতটুকু হবে? এবং এটি কি সত্যই ইন্টারনেটের গোপনীয়তার সমস্যা সমাধান করতে পারবে? প্রশ্নগুলির উত্তর দিয়েছেন টিম বার্নার্স-লি।
.
প্রশ্ন: অনলাইন গোপনীয়তার বিষয়টি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
টিম বার্নার্স-লি: বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে আপনার তথ্য থাকাটাই কেবল অনলাইনে গোপনীয়তার অভাব নয়। বরং তারা যেভাবে এই তথ্য ব্যবহার করে আপনি পরবর্তীতে কীসে ক্লিক করবেন, তা খুঁজে বের করে, সেটাও এই গোপনীয়তার অভাবের অংশ। তারা এসব তথ্য ব্যবহার করে আপনাকে এমন সব জিনিসে ক্লিক করাবে, যেখানে আপনার যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এজন্য তারা আপনাকে ক্লিকবেইট অনুসরণ করাবে।
ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে তারা আপনার একটি প্রোফাইল তৈরি করেছে এবং খুব ভালোভাবেই জানে আপনি কেমন ব্যক্তি। কীভাবে আপনাকে রাজনীতি, বাণিজ্য বা অপরাধ সংক্রান্ত মিথ্যার চক্করে ধোঁকা দেয়া যায়, তা তারা জানে।
আরেকটু ব্যাখ্যা করি। লোকে আপনার সাথে সম্বন্ধযুক্ত ডেটা ব্যবহার করে অন্যান্য মানুষদের এমন ভাবে বোকা বানাতে পারে যে, তারা এমন কাউকে ভোট দিবে যাকে ভোট দেয়া অনুচিৎ। এমন কাউকে ভোট দিবে, যারা তাদের জন্যে আদর্শ নয়।
.
প্রশ্ন: আপনার উদ্ভাবনকে এভাবে অপব্যবহার করা যেতে পারে জেনে কেমন লাগে?
টিম বার্নার্স-লি: ১০ বছর আগে হলে আমি বলতাম যে মানুষ ওয়েব ব্যবহার করে এবং আপনি মানুষের দিকে নজর দিলে ভাল এবং খারাপ উভয়ই দেখতে পাবেন।
কিন্তু, ২০১৬ সালের দিকে (ফেসবুক-কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ডেটা কেলেঙ্কারির সময়) আমি বুঝতে পারি যে, আমার পরিচিত লোকেরা যদি নির্ভরযোগ্য, বিজ্ঞান-সম্মত তথ্যের জন্যে তাদের বুকমার্ক ব্যবহার করেন, তাহলে খুবই ভালো। কিন্তু আমার অপরিচিত অনেক মানুষ আছেন, যাদের বুকমার্কগুলি খুবই আলাদা ধরনের।
তারা এমন সব জিনিস পড়তে পারেন, যা সত্য নয়। আর বিষয়টি গণতন্ত্রের সাথে জড়িত না হলে তাদের এই পড়া নিয়ে আমি বরং খুশিই থাকতাম। কিন্তু, যেহেতু তারা ভোট দেয়, তাই ওয়েব থেকে, বিশেষ করে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক থেকে আমাদের আরো বেশি কিছু পাওয়ার আছে। তাদের একটি দায়িত্ব রয়েছে। কারণ আমাদের এমন ভোটার প্রয়োজন, যারা জানে, বোঝে এবং বিতর্কে অংশ নিতে পারে।
.
প্রশ্ন: কোটি কোটি ব্যবহারকারী অনায়াসে তাদের তথ্য বিগ টেক কোম্পানিগুলির হাতে তুলে দিয়েছে। এর মানে কি এই নয় যে ওয়েব প্রাইভেসি বেশিরভাগ মানুষের কাছে সত্যিকারের কোনো সমস্যা নয়?
টিম বার্নার্স-লি: বেশিরভাগ মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে নিজেদের গোপনীয়তা নিয়ে চিন্তিত নয়। কিন্তু প্রায়ই কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারির মতো কিছু না কিছু ঘটে থাকে। এই ধরনের ঘটনার পরে সাধারণ মানুষ এই ভেবে উদ্বিগ্ন হতে পারে যে, তারা এমন একটি সিস্টেমের অংশ, যা নির্বাচনকে প্রভাবিত করছে। গোপনীয়তা রক্ষার জন্য যদি তাদের বিকল্প ব্যবস্থা সরবরাহ করা যায়, তাহলে তারা আরও সচেতন হয়ে উঠতে পারে।
প্রতিবার যখন কোনো বৃহত্তর সামাজিক নেটওয়ার্কে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে, তখন বিশাল সংখ্যক মানুষ মিউই (MeWe) এর মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কে চলে যায়, যা আপনার তথ্য নিয়ে কিছুই করে না।
.
প্রশ্ন: ইন্টারনেটকে ঠিক করতে আমাদের কি খুব বেশি দেরি হয়ে গেছে?
টিম বার্নার্স-লি: বিষয়গুলি কীভাবে এত দ্রুত পরিবর্তিত হতে পারে, তা আশ্চর্যজনক। কয়েক বছর আগে মানুষ চিন্তিত ছিল যে, নেটস্কেপ প্রতিটি ব্রাউজারে আধিপত্য বিস্তার করে আছে। এবং তারপরে মাইক্রোসফট হাজির হয় এক্সপ্লোরার নিয়ে, যা প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। এরপর অন্যান্য অনেক ব্রাউজার আসার আগ পর্যন্ত মানুষ এ নিয়েই চিন্তিত ছিল। আর এখন লোকেরা বলছে, "ওহ না, প্রত্যেকে একই সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করছে!"
ঠিক আছে, সমস্যা এক সময় শেষ হয়। সাধারণভাবে, ওয়েব খুব ভালোভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, প্রাচীর ঘেরা বাগান যতই সুন্দর হোক, বাইরের জঙ্গল সব সময়ই বেশি মূল্যবান।
উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতা সব সময়ই প্রভাবশালী।
.
প্রশ্ন: সলিড-এর মতো একটি সিস্টেম তৈরি করতে গিয়ে কি প্রথম বারের মতো ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব তৈরির মতো অনুভূতি হচ্ছে?
টিম বার্নার্স-লি: হ্যাঁ! ব্যাপারটা সত্যিই রোমাঞ্চকর, কারণ এটা হলো একটা নতুন সিস্টেম তৈরি করা। তবে এটা ওয়েবের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। কারণ সলিড-এর মতো বিকেন্দ্রীভূত সিস্টেম যে পৃথিবীতে আছে, তা কেমন হবে ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন।
আমরা এখন পর্যন্ত যা জানি, তা থেকে সলিড ভিন্নধর্মী। এর কারণ হল সলিড-এর সহায়তাকারী সক্ষমতা। যেমন, আপনি যদি কোনো ভিডিও কলে থাকেন, তবে আপনি এবং যার সাথে আপনি কথা বলছেন উভয়েই যেকোনো ভিডিও কল অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন।
মানুষ এই মুহূর্তে যে সমস্যাটির মুখোমুখি হচ্ছে, তা হলো এই ধারণাটি যে, আপনার ব্যাক এন্ড-এর কাজটি করতে হবে না। অর্থাৎ আপনি যদি কোনো ওয়েবসাইট তৈরি করেন, তবে গ্রাহকের ডেটা সংরক্ষণ করার জন্য আপনাকে একটি ডাটাবেস তৈরি করতে হবে না। এর কারণ হলো পিওডিএস একটি মানসমৃদ্ধ সুরক্ষিত ডেটা সেট সরবরাহ করবে।
.
প্রশ্ন: সলিড কি একাই ইন্টারনেটের গোপনীয়তার সমস্যা সমাধান করতে পারে? নাকি সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থারও এ নিয়ে কাজ করা উচিৎ?
টিম বার্নার্স-লি: একটি আদর্শ সমাজে আপনাকে প্রযুক্তি ডিজাইন করতে হবে সমাজকে সাথে নিয়েই। যেমন, জিডিপিআর [ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন, যা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে ডেটা সংগ্রহ করার হারকে ন্যূনতম করে তোলে] সলিড-এর সাথে অবিশ্বাস্যভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সলিড আপনাকে কেবল কারা ডেটাতে অ্যাক্সেস পাবে, তা নিয়ন্ত্রণ করতে দেয় না, একই সাথে আপনি সেই অ্যাক্সেসটিকে একটি সুইচ দিয়ে বন্ধও করে দিতে পারবেন। তবে, আমি যদি চিকিৎসা গবেষণার জন্য ডেটা হস্তান্তর করি, তাহলে পরবর্তীতে আমি চাইলেও এমন কোনো প্রযুক্তি নেই যা ডেটাগুলিকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারবে। একজন ব্যবহারকারী হিসাবে যদি আমি অ্যাক্সেসটি প্রত্যাহার করি, তবে এটি করার জন্য আমার নিয়ম এবং আইন দরকার। এই সমস্যাটি সমাধান করার জন্যে আমাদের নিয়ম এবং প্রযুক্তি দুটিই দরকার।
সূত্র. সায়েন্স ফোকাস ম্যাগাজিন (১৫ এপ্রিল ২০২১)
#সাক্ষাৎকার #সলিড #টিমবার্নার্সলি